কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান হারিয়ে যেতে বসেছে: অবশিষ্ট বনাঞ্চল, অবকাঠামোও বিলীন

- আপডেট সময় : ০৫:৩২:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫ ৪৫ বার পড়া হয়েছে
কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এক সময় যে উদ্যান ছিল ঘন বনভূমি, বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং পর্যটকদের আগমনে মুখর-আজ সেখানে পড়ে আছে কেবল ধ্বংসস্তূপ। প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে জাতীয় উদ্যানের অস্তিত্ব।
গত বৃহস্পতিবারের জলোচ্ছ্বাসের দুদফা আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে উদ্যানের গেট, সীমানা প্রাচীর এবং অবকাঠামো। কোথাও পড়ে আছে কঙ্কালের মতো ভেঙে পড়া গেট, কোথাও উপড়ে পড়া শত শত ঝাউগাছ লাশের মতো শুয়ে আছে বালুচরে।
স্থানীয়রা জানান, এসব ধ্বংসাবশেষ এখন অনেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান নামটি শুধুই কাগজে-কলমে টিকে আছে। বাস্তবে যা অবশিষ্ট, তা বলতে গেলে একটি ভবন ছাড়া আর কিছুই নয়।
২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর, কুয়াকাটা, গঙ্গামতি ও খাজুরা ক্যাম্প মিলিয়ে ১৬১৩ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমিতে ‘কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করে বন বিভাগ। উদ্দেশ্য ছিল উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং পর্যটনের উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়ন কার্যক্রম তেমন এগোয়নি। উল্টো গত এক দশকে সাগরের ভাঙনে দুই-তৃতীয়াংশ বনভূমি বিলীন হয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, দুই দশক আগেও যেখানে ছিল গহীন বন, এখন সেখানে দিগন্তজোড়া ফাঁকা প্রান্তর। বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে নির্বিচারে। অভিযোগ রয়েছে, বন ধ্বংসে বনখেকো চক্র, কিছু বনপ্রজা এবং বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত ছিল। কথিত বন্দোবস্তের নামে বহু জায়গা দখল হয়ে গেছে। কোথাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে গাছপালা। অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি।
সবশেষে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাকি থাকা অবকাঠামোও ভেঙে পড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন যারা কুয়াকাটা ভ্রমণে আসেন, তারা জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য নয়, বরং এক ধ্বংসপ্রাপ্ত নিদর্শন দেখে ফিরে যান হতাশায়।
কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, “কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা ছাড়া ঝাউবন, জাতীয় উদ্যান, বেরিবাঁধ কিংবা যেকোনো স্থাপনা রক্ষা সম্ভব নয়। সৈকতই হলো এই এলাকার সবকিছুর ভিত্তি। যদি সৈকতই বিলীন হয়ে যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে কুয়াকাটা অঞ্চল রক্ষার কোনো উপায় থাকবে না। বর্তমানে ঝাউবন, জাতীয় উদ্যানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হুমকির মুখে রয়েছে। যদিও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এখনো যথেষ্ট নয়। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। একটি টেকসই ও সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষা করা গেলে, এখানকার সব ধরনের স্থাপনা, বাঁধ ও বনও রক্ষা পাবে। তাই আমাদের এখনই সরকারিভাবে একটি স্থায়ী ও ফলপ্রসূ পরিকল্পনার প্রয়োজন।”
কলাপাড়া পরিবেশকর্মী মেজবাহউদ্দিন মাননু বলেন, বিষয় টি উদ্বেগজনক। গত ২৪ বছরে সৈকতের ৭৫ শতাংশ ম্যানগ্রোভ ননম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। বলতে গেলে দুর্যোগকালীন জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা প্রতিরোধে সবুজ দেয়ালখ্যাত রক্ষাকবচ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন প্রয়োজন সৈকত রক্ষায় স্থায়ীভাবে পদক্ষেপ নেওয়া। নইলে সংকট হবে ভয়াবহ। দুঃখের বিষয় সাগরের জলোচ্ছ্বাস ঝুঁকিতে রয়েছে ১৮ কিলোমিটার সৈকত। অথচ প্রত্যেক বছর জিরো পয়েন্টের আশপাশের জরুরি প্রটেকশন দেওয়া হয়।
বনবিভাগ মহিপুর রেঞ্জের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেএম মনিরুজ্জামান বলেন, “আমি সদ্য যোগদান করেছি। সরেজমিন পরিদর্শন করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব বিস্তারিত জানাব।”
পর্যবেক্ষকদের মতে, এখনই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, উপকূলীয় বনাঞ্চল রক্ষায় টেকসই ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা। নইলে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের নামও একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে।